Stephen and Chirki murmu's love story

চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ

-সুবোধ ঘোষ


আমাদের ক্লাসটা ছিল একটি নৃতত্ত্বের ল্যাবরেটরির মতাে। এমন বিচিত্র মানবতার নমুনা আর কোন্ স্কুলে কোন্ ক্লাসে আছে জানি না। তিনটি রাজার ছেলে ছিল আমাদের ক্লাসে। একজন জংলি রাজার ছেলে, কুচকুচে কালাে চেহারা। আর দুজন ছিল সত্যিকারের ক্ষত্রিয়াত্মজ— সুগৌর গায়ের রং, পাগড়িতে সচ্চা মােতির ঝালর ঝুলতাে। তা ছাড়া ছিল— সিরিল টিপ্পা,ইমানুয়েল খালখাে, জন বেস্ত্রা, রিচার্ড টুডু আর স্টিফান হােরাে এবং আরাে অনেক। এত ওরাওঁ আর মুন্ডা সন্তানের সমাবেশের মাঝখানে তবু আমরা কজন ইন্টার ক্লাস পরিবারের বাঙালি ও বিহারি ছেলে শুধু বুদ্ধির জোরে সর্বকর্মের মােড়লির গৌরব অধিকার করে বসেছিলাম। রাজার ছেলেগুলাকে আমরা বলতাম সােনা ব্যাঙ, আর মুন্ডা ও ওরাওঁদের বলতাম কোলা ব্যাঙ। ওদের কাউকে আমরা কোনাে দিন গ্রাহ্যের মধ্যে আনতাম না। রাজার ছেলেগুলি অবশ্য আমাদের সঙ্গে কথা বলত না। অপরপক্ষে টিগা, খালখাে, বেসরা, টুডু ওরা আমাদের সঙ্গে দুটো কথা বলতে পারলে ধন্য হয়ে যেত। টিফিনের সময় একটা আনি নিয়ে টুডুকে দিতাম। বলতাম—টুডু, চট করে এক দৌড়ে এই এক আনার ঝালবাদাম নিয়ে এসাে তাে। গঙ্গা সাহুর দোকান থেকে আনবে। স্কুল থেকে গঙ্গা সাহুর দোকান দেড় মাইল হবে। কৃতার্থভাবে আনিটা হাতে তুলে নিয়ে টুডু সেই প্রচণ্ড রােদে ঝলসানাে মাঠের ওপর দিয়ে পােড়া হরিণের মতাে উদ্দাম বেগে দৌড়ে চলে যেত গঙ্গা সাহুর দোকানে। ফিরে এসে ঝালবাদামের ঠোঙাটা আমাদের হাতে সঁপে দিয়ে নিজে দূরে সরে যেত। আমরা বলতাম— কী আশ্চর্য টুডু, এতটা পথ দৌড়ে এলে তবু তুমি একটুও হাঁপাচ্ছে না। এই ফঁাকা কথার কারসাজিটাকে আন্তরিক অভিনন্দন মনে করেই টুডু দূরে এড়িয়ে গর্বভরে হাসত! আমরা চোখ টিপে লক্ষ করতাম- টুডু কেমন জোর করে তার পরিশ্রান্ত শ্বাসবায়ুটাকে ঢোক গিলে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তাকে ঝালবাদামের একটু শেয়ার দিতে আমরা বােধ হয় ইচ্ছে করেই ভুলে যেতাম। দিতে গেলেও টুড় নিত না। আমরা দেখতাম, একটু দূরে দাঁড়িয়ে সুতীব্র একটা দৃষ্টি দিয়ে স্টিফান হােরাে আমাদের হাবভাব লক্ষ করছে। আমরা ঘাবড়ে যেতাম। স্টিফান যেন তির মেরে
আমাদের বুকের ভেতরে ধূর্ত রসিকতায় তৈরি ফুসফুসটাকে খোঁচা দেখছে। সব বুঝে ফেলতে পারছে। কিন্তু সবার মধ্যে একমাত্র স্টিফাই পারে, আর কেউ নয় ?

টুড়, খালখাে, টিগ্গা, বেসরা সকলেই কতকটা এই রকমেরই বাধ্য বেকুব বিশ্বাসী আর নিরীহ ছিল। আমরা মনে মনে হাসতাম।-- হায়রে, রাঁচির জঙ্গলের যত কোল, যত সব কোলা ব্যাঙ!

ওদের মধ্যে ওই একটিমাত্র কাল কেউটে ছিল, স্টিফান হােরে।। বড়াে উন্বত ছিল স্টিফানের স্বভাবটা। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, হােরাের কাছে আমাদের আভিজাত্য চুপে চুপে হার মেনে নিত। ওর সঙ্গে সদ্ভাব রাখার জন্য মাঝে মাঝে যেচে ওর সঙ্গে কথা বলতে হয়েছে। আরও লজ্জার বিষয় হােরাে এক এক সময় আমাদের প্রশ্নের কোনাে উত্তর না দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিত। ওই মাথা ঠাসা মােটা মােটা চুলের ঘুঙর, চ্যাপটা নাক, আবলুস কালো চেহারা তবু এত অহঙ্কার !

স্টিফানের ওপর প্রথম একটু ভয় ও শ্রদ্ধা হল একটা ঘটনায়। সেদিন খেলার মাঠে দেখলাম হােরাে হকি স্টিক আনেনি। হােরাে তবু খেলতে চায়। কিন্তু নিজের হকি নিয়ে খেলতে হবে এই ছিল আমাদের নিয়ম। হােরাে বার বার আমাদের অনুরােধ করল- কিছুক্ষণের জন্য কেউ আমাকে একটা স্টিক ধার দাও, এক হাত খেলেই তাবার দিয়ে দেব।

কেউ কারও ঠিক পরের হাতে দিতে রাজি ছিল না। হােরাে বললাে-- আমি বিনা স্টিকেই খেলবাে।'

গোয়ার হােরাে একটি ঘণ্টা আমাদের উদ্দাম হকি স্টিকের বাড়ি আর আছাড়ের সঙ্গে সমান স্বাচ্ছন্দ্যে পা দিয়ে খেলে গেল। হােরাের দুটি নিরেট শিশু কাঠের মতাে পায়ের ওপর বেপরােয়া হকিস্টিক চালাবার সময় এক একবার সন্দেহে আমাদেরই। কেঁপে উঠেছে— স্টিকটাই ভেঙে না যায়।

স্টিফান হােরাে ক্রমেই আমাদের ভাবিয়ে তুলছিল। শুধু ভয় আর শ্রদ্ধা নয়-আর একটা কারণ আমরা হােরােকে একবার ঈর্যা করতে আরম্ভ করলাম। লেখা পড়ার ব্যাপারে হােরাে তামাদের মনের শান্তি নষ্ট করতে চলেছে। ইংরাজি কবিতার। আবৃত্তি ও ব্যাখ্যায় সে আমাদের ইন্দুকেও পরাজিত করে ছাব্বিশ নম্বর বেশি পেল। ঘটনাটা জাতীয় অপমানের মতাে আমাদের গায়ে বিবল। বেহারি ছাত্রদের জাতীয়তা কতটা ক্ষুন্ন হয়েছিল জানি না, কিন্তু হােরাের সম্পর্কে একটা নিন্দার ষড়যন্ত্রে তারাও আমাদের সঙ্গে ইউনাইটেড ফ্রন্ট করল। আমরা বেশ জোর গলায় রটিয়ে দিলাম- এ স্কুলে খ্রিস্টানদের ওপর বড়াে বিচার চলছে। মাস্টারেরা সবাই খ্রিস্টান। সুতরাং খ্রিস্টান হােরো বেশি নম্বর পাবে তাতে আর আশ্চর্য কি? কিন্তু কী ভয়ানক আমাদের অভিযােগকে মনে প্রাণে সত্য বলে বুঝলেন শুধু একমাত্র অখ্রিস্টান শিক্ষক। সংস্কৃতের মাস্টার বৈজনাথ শর্মা- পণ্ডিতজি।

পণ্ডিতজি আমাদের সান্ত্বনা দিলেন। কী আর করবে বাবা! পাদরিদের স্কুলে এইরকমই অন্যায় কাণ্ড হয়ে থাকে। যাক, ইউনিভার্সিটি তাে আছে। সেইখানে ধরা পড়ে যাবে কার কতখানি যােগ্যতা।

প্রমােশনের পর নতুন বছরে স্টিফান হােরাে আরও ভয়ানক এক গোয়ার্তুমি করে বসলাে— পা দিয়ে হকি খেলার চেয়েও ভয়ানক। স্টিফান হােরাে তার অ্যাডিশনাল ইংরাজি ছেড়ে দিয়ে সংস্কৃত নিল। খ্রিস্টান টিচারেরা সবাই হােরােকে ধমকালেন, হেডমাস্টার ফাদার লিন্ডন ক্ষুন্ন হলেন, পণ্ডিতজি অদ্ভুতভাবে হাসতে লাগলেন। তবু অনার্য হােরাের সংস্কৃত পড়ার প্রতিজ্ঞা তিলমাত্র বিচলিত হল না।

পণ্ডিতজি আমাদের আড়ালে ডেকে নিয়ে একটা অস্বস্তির হাসি হেসে বললেন— স্টিফান হােরাে সংস্কৃত নিয়েছে। আর কি? এইবার দেবভাষার কপালে কী আছে কে জানে।

পণ্ডিতজি হাসতে লাগলেন। আমাদের কেমন সন্দেহ হল। পণ্ডিতজিকে যেন খুশি খুশি দেখাচ্ছে! যাক।

শীঘ্রই আমাদের যত ধারণা সংশয় আক্রোশ ও আশঙ্কা পর পর কতগুলি ঘটনায় আরও জটিল হয়ে উঠতে লাগল।

নিউ টেস্টামেন্ট থেকে ডেভিডের গাথাগুলি আগাগােড়া নির্ভুল আবৃত্তি করে ফাস্ট প্রাইজ পেল স্টিফান হােরাে। সেকেণ্ড, থার্ড, ও ফোর্থ প্রাইজের অগৌরবে মুখ শুকনাে করে আমরা বসে রইলাম। ফাদার লিন্ডন উচ্ছ্বসিত আনন্দে হােরাের প্রশংসা করে ঘােষণা করলেন— ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তােমায় নিশ্চয় দারােগা করে দেবাে হােরাে, আমি প্রতিশ্রুতি দিলাম।

তা করতে পারেন ফাদার লিন্ডন। এতটুকু সুপারিশ করার ক্ষমতা তার আছে, কিন্তু ওইটুকু যদি স্টিফান হােরাের জীবনের পরমার্থ হয়, হােক, তার জন্য আমরা মােটেই হিংসা করি না। তার জন্য এত কষ্ট করে নিউ টেস্টামেন্ট মুখস্থ করার দরকার নেই আমাদের।

তার পরের দিনই বাইবেল ক্লাসে হােরােকে একেবারে ভিন্ন রূপে দেখতে পেলাম আমরা। দুর্বোধ্য বিস্ময়ে আমরা শুধু খাবি খেতে লাগলাম।

বাইবেল ক্লাসের একেবারে পেছনের বেঞ্চিতে বসেছিল হােরাে। পড়াতে পড়াতে ফাদার লিন্ডন বার বার পুলকিত নেত্রে হােরােকে প্রশ্ন করছিলেন— স্টিফান তুমিই উত্তর দাও। তুমিই সবচেয়ে ভালাে উত্তর দিতে পারবে।

-জানি না স্যর। স্টিফানের রুক্ষ গলার স্বরে চমকে উঠে আমরা সবাই তার দিকে তাকালাম। দেখলাম, স্টিফান হােরাের আরও রুক্ষ ও বিরক্ত মুখটা ডেস্কের ওপর ঝুঁকে রয়েছে। ফাদার লিন্ডনের দিকে যেন তাকাতে চায় না হােরাে।
ফাদার লিন্ডনের সােনালি দাড়ির ওপর লালচে মুখে ক্ষণে ক্ষণে গাঢ় রক্তচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ছিল। চোখের দৃষ্টিটা তীব্র হয়ে উঠছিল। স্টিফানের দিকে তাকিয়ে বুষ্ট স্বরে বললেন- স্টিফান, আজ কি তােমার ব্রেনটাকে দরজার বাইরে রেখে ক্লাসে এসেছে তুমি? উত্তর দিতে পারছ না কেন?

-জানি না স্যর। আবার স্টিফান হােরাের সেই স্পষ্ট অবিচল ও অকুতােভয় উত্তর শুনে আমাদের বুকে দুরু দুরু শুরু হয়ে গেল। আকস্মিকভাবে অসময়ে ক্লাস বন্ধ করে ফাদার লিন্ডন চলে গেলেন।

কিন্তু স্টিফান হােরাের এত রাগ কেন? এত অভিমান কেন? নিউ টেস্টামেন্ট মুখস্থ করে কার মাথা কিনেছে? কি হতে চায়? হাউস অব লর্ডস্-এর সদস্য?

এর পর বিপদে পড়লেন পণ্ডিতজি। পণ্ডিতজির মতিগতিও কদিন থেকে * কেমন একটু বিসদৃশ দেখাচ্ছে। আমাদের এড়িয়ে যেতে পারলেই যেন পণ্ডিতজী একটু সুস্থ বােধ করেন। দেখা হলেই ব্যস্ত হয়ে সরে পড়েন। অথচ পণ্ডিতজীকে কত কথাই না জিজ্ঞাসা করার আছে। ফাস্ট টার্মিনাল পরীক্ষা হয়ে গেছে। এই ততা যত নম্বর প্রমােশন আর পজিশন নিয়ে একটা দুশ্চিন্তা গবেষণা ও কৌতূহলের সময়। পণ্ডিতজির উদার হাতের নম্বর অনেক সময় আমাদের টোটালকে পরিস্ফীত করে কৃপণ খ্রিস্টান শিক্ষকদের যড়যন্ত্র থেকে আমাদের বাঁচিয়েছে। আজও আমরা তাই জানতে চাই— পণ্ডিতজি কার জন্যে কতদূর করলেন। ইন্দুকে যদি একবার বুক ঠুকে পঁচাশি দিয়ে দেন তবে টোটালে তার ফাস্ট হওয়া সম্বন্ধে আর কোনাে সংশয় থাকে না। সব খ্রিস্টানি যড়যন্ত্র জব্দ হয়ে যায়।

পণ্ডিজির বাড়িতে গিয়েছি, লাইব্রেরি ঘরে একা একা পেয়েছি, পথে পথরােধ করেছি কিন্তু পণ্ডিতজি কিরকম গােলমেলে কথা বলে সব কৌতূহল যেন চাপা দিতে চান। আমাদের সন্দেহ আরও প্রখর হয়ে ওঠে।

আতা আমতা করে দুবার মাথা চুলকিয়ে পণ্ডিতজি সত্য সংবাদটা ব্যক্ত করে দিলেন। সংস্কৃতে স্টিফান হােরাে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছে, একশাের মধ্যে পঁচাত্তর।

—আর ইন্দু? আমাদের প্রশ্নে একটু অপ্রস্তুত হয়ে পণ্ডিতজি অপরাধীর মতাে বললেন— বত্রিশ।

মাত্র বত্রিশ ! পণ্ডিতজির মতাে বিশ্বাসহন্তা পৃথিবীতে আর নেই। আমাদের (ক্ষোভ অসংযত হয়ে উঠেছিল। পণ্ডিতজি মিনতি করে বললেন— স্টিফান হােরাে এত ভালাে সংস্কৃত লিখেছে, এ-তাে তােমাদেরই গৌরব, আর্যভাষার গৌরব। এতে তাে তােমাদের খুশি হবার কথা। এটা হােরাের জয় নয়, এটা হল সংস্কৃত ভাষার জয়।

চুলােয় যাক সংস্কৃত ভাষার জয়। ইন্দু ফার্স্ট হতে পারবে না, এটা যে আর্যত্বের চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ

কত বড়াে পরাভব, বাঙালির কত বড়াে অপমান— তা পণ্ডিতজি বুঝলেন না। কিন্তু আমরা ঠিক রহস্যটি বুঝে ফেললাম— পণ্ডিতজি হলেন বেহারি, তাই।

কিন্তু বাতাসের নিশ্চয় সেই পরম গুণ আছে, যার জন্য শত অন্যায়ের অবরােধের মধ্যেও ধর্মের কল নড়ে উঠে। লাইব্রেরি ঘরে যেদিন বাের্ড নিবদ্ধ মার্কশিটের কাছে আমরা গিয়ে চোখ তুলে দাঁড়ালাম, সেদিন আমরা বিশ্বাস করলাম- সত্যের জয় আছে, মিথ্যার পরাজয় আছে।

ইন্দুই ফাস্ট হয়েছে। স্টিফান হােরাে অনেক নীচে। ইংলিশে, ইতিহাসে, ভূগােলে, অঙ্কে— সব বিষয়ে অতি নগণ্য নম্বর পেয়েছ স্টিফান হােরাে, একমাত্র সংস্কৃত ছাড়া। ভেবে অবাক হলাম আমরা, খ্রিস্টান টিচারেরা হােরাের ওপর হঠাৎ এত নির্দয় হয়ে উঠলেন কেন?

আরও কিছুদিন পর স্টিফান হােরাে আমাদের কাছে একেবারে দুর্বোধ্য হয়ে গেল। শুধু আমাদের কাছে নয়, খালখাে, বেরা, টিগা সবাই বলাবলি করে— কী জানি হয়েছে হােরাের!

বড়ােদিনের উৎসবে আমরাও পিকনিক করতে গিয়েছিলাম শিলােয়ারার জঙ্গলে। রান্নার কাঠের জন্য মহা উৎসাহে একটা মরা কেঁদ গাছ ভাঙছিলাম আমরা। হঠাৎ দেখলাম, স্রোতের ধার দিয়ে একা একা হােরাে চলেছে। হাতে একটা গুলতি। আমরা চেঁচিয়ে ডাকলাম হােরােকে। এ রকম অভাবিত ভাবে হােরাে যখন এসেই পড়েছে, তখন সেও আমাদের সঙ্গে এই বনভােজনের আনন্দের একটু শেয়ার নিক না কেন। পােলাও হবে, মাংস হবে, দই আছে, বৈকুণ্ঠ ময়রার সন্দেশ আছে। খেয়ে খুশি হবে হােরাে। একেবারে আনকোরা মুন্ডা,জীবনে বােধ হয় এসব খায়নি কখনও।

হােরাে এগিয়ে এল। আমাদের কাছে এসেই একটা শাল গাছের শাখার দিকে নিবিষ্টভাবে তাকিয়ে রইল। তার পরেই শিকার লক্ষ্য করে গুলতি তুলে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে একটা হৃষ্টপুষ্ট কাঠবিড়ালি' আহত হয়ে ধপ করে মাটির ওপর পড়ল। একটা লাফ দিয়ে আহত কাঠবিড়ালিটাকে লুফে নিয়ে পকেটের ভেতর রাখলাে । স্টিফান।

আমরা আতঙ্কিত হয়ে প্রশ্ন করলাম— ওটা কী হবে স্টিফান।

খাব। নিঃসংকোচে কথাটা বলে ফেলল হােরাে। মনের ঘেন্না চেপে রেখে তবু আমরা হেরােকে নিমন্ত্রণ করলাম। ওসব ছুঁড়ে ফেলে দাও স্টিফান। পাগল কোথাকার। এসাে আমাদের পিকনিকে তুমিও খাবে আমাদের সঙ্গে।

। হােরাের কালাে মুখের ভেতর থেকে ঝঝকে দুপাটি সাদা দাঁতের হাসি আপত্তি জানাল।

এ রকম জংলি হয়ে যাচ্ছে কেন স্টিফান? রিটার্ড টুডু একদিন কানে কানে আমাদের বলল, সত্যিই কি জানি হয়েছে হােরাের। বােধ হয় শীগগির পাগল হয়ে যাবে। ফাদার লিন্ডন আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন, হােরাের সঙ্গে যেন কেউ না মেশে।

আমরা জিজ্ঞাসা করলাম। কেন টুডু।

টুডু— একজন বুড়াে সােখার সঙ্গে আজকাল বড়াে ভাব হয়েছে। লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিদিন মঙ্গলবারের হাটে গিয়ে সেখার সঙ্গে দেখা করে হেরাে। —তাতে কী এমন অপরাধ করেছে হােরাে?

টুডু ভুরু কুঁচকে বলল– অপরাধ নয়? এতে বাইবেলের অপমান করেছে হােরাে। চার্চে যায় না। কারও কথা শােনে না। তিন দিন বাের্ডিংয়ে ছিল না। ওকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে।

—বাের্ডিংয়ে ছিল না? কোথায় ছিল?

টুডু গলার স্বর আরও নামিয়ে চুপে চুপে বলল— বুরুতে গিয়েছিল। সেখানে নেচে গেয়ে এসেছে। পেট ভরে ইলি খেয়ে নেশা করেছে। তা ছাড়া...।

টুডু হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল। একটা কথা বলছি, কাউকে বলাে না যেন। জানতে পারলে হােরাে আমায় মেরে ফেলবে।

টুডুকে অভয় দিলাম। না, কেউ জানতে পাবে না, তুমি বলাে।

টুডু— একটি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব হয়েছে। মেয়েটার নাম চিরকি, মােরাঙ্গি পাহাড়ের মুরমুদের মেয়ে।

টুডুর কথাগুলি মুগ্ধ হয়ে যেন গিলছিলাম আমরা। আমাদেরই সহপাঠী— দীন দরিদ্র মুন্ডা হােরাে, কতই বা বয়স, তবু সেই হােরাে আজ এক মুহূর্তে আমাদের বাইবেল ক্লাস, সংস্কৃতের নম্বর আর হকি খেলার সব আনন্দ উত্তেজনাকে মূল্যহীন করে দিয়ে, এক রােমাঞময় অনুরাগের স্কুলে গিয়ে সবার অগােচরে নাম লিখিয়ে এসেছে। সেই মেয়েটি, চিরকি মুরমু তার নাম, তাকে যেন আমরা চোখে দেখতে পাচ্ছি। শাল ফুলের মালা গলায় দিয়ে, খোঁপায় একটা বনজবা খুঁজে, স্রোতের ভাষার মতাে খলখল হাসির বন্ধনে হােরাের কালাে হৃদয়ের সব দুরন্তপনাকে বন্দি করে কোন্ উপত্যকার একটি নিভৃতে নিয়ে চলে গেছে। সেখান থেকে ফিরে আসার সাধ্য নেই হােরাের। কোন্ সাধেই বা আসবে?

টুড় তখনও সেই রকম পাকা পাকা কথা বলে চলেছিল। মুরমুরা বােঙা পুজো করে, ওদের সঙ্গে মেলামেশা কি উচিত হল? বড়াে ভুল করেছে হােররা।

স্টিফান হােরােকে বাের্ডিং থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে, এটা শুধু একটা গুজব হয়েই রইল। কার্যত দেখলাম, হােরােকে তাড়ানাে হল না। নিজের ইচ্ছে মতাে ক্লাসে আসে হােৱাে। নিজের ইচ্ছে মতােই অনুপস্থিত হয়। তানত খ্রিস্টান ছাত্রেরা হােরোকে এড়িয়ে যায়। হােৱাে যেন এক ঘরের মধ্যেই একঘরে হয়ে আছে। চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ

রিচার্ড টুডু যে-আশঙ্কা প্রচার করেছিল, কাজের বেলায় দেখলাম তার উল্টোটাই হয়েছে। হােরােকে বাের্ডিং থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়নি। সে বাের্ডিংয়েই আছে, অথচ তার সম্পর্কে যেন সব শাসন প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে।

আমরা দেখে অবাক হয়ে যেতাম, এক একদিন বিকেলে ফাদার লিন্ডন টেনিস খেলছেন হােরাের সঙ্গে। আশ্চর্য! টুডু বেপ্রা টিএরা হােরাের চেয়ে কম কালাে আর বেশি বিশ্বাসী খ্রিস্টান। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওরা শুধু ফাদার লিন্ডনের টেনিস খেলার সময় বল কুড়িয়ে দেবার মর্যাদা পেয়েছে। তার বেশি নয়। আর স্টিফান একেবারে... সত্যি আশ্চর্য।

বাের্ডিংয়ের বাগানে বিকালবেলা জল দেবার ভার ছিল হােরাের ওপর। এই কর্তব্যটুকুর বিনিময়ে হােরাে বাের্ডিংয়ে ফ্রি খেতে পেত আর থাকত। আমরা দেখলাম, হােরাে আর বাগানে যায় না, জল তােলে না। উদ্যানসেবার ভার টিগঙ্গার ওপর চাপানাে হয়েছে। বেচারি টিগ্গা! সকালবেলার রান্নার জন্য কাঠ কাটে, তার ওপর আবার বিকেলবেলা জল তােলা!

টুডু এসেই আর একদিন একটা খবর দিল— আজকাল আর হাটে যাবার সুযােগ পায় না স্টিফান, প্রতি মঙ্গলবার সারা দুপুর ফাদার লিন্ডনের ঘরে বসে পিলগ্রিস প্রগ্রেস পড়ে। পড়া শেষ হলে নাকি চা-বিস্কুট খায় হােরাে। ফাদার লিন্ডন খাওয়ান।

আমাদের উৎসাহ ঔৎসুক্য আলােচনা আর গবেষণার সীমা ছিল না। অলক্ষ্যে কত বড়াে একটা ঘটনার দ্বন্দ্ব জমে উঠেছে, তার কিছু কিছু আভাস আমরা আমাদের অনুভব দিয়ে ধরতে পারছিলাম। এক দিকে কেম্ব্রিজের এম.এ বিখ্যাত শিক্ষিত সুসভ্য ও শ্রদ্ধেয় ফাদার লিন্ডন।...অপর দিকে কোন এক জংলি মুন্ডা ডিহির বুড়াে সােখা দীনতম নগণ্য অধোলঙ্গ বর্বরবেশী এক যাদুমন্ত্রী। যেন দুই যুগে লড়াই— বিংশ শতক বনাম প্রাক্‌ ইতিহাস। বুড়াে সােখা বােধ হয় সে লাঞ্ছনা ভুলতে পারে না— ছেলেধরা পাদরিরা তাদের ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়েছে, খ্রিস্টান করে দিয়েছে হােরােকে। তারই প্রতিশােধ নেবে বুড়াে সােখা। এই সুসভ্য ডাইনদের দুর্গ থেকে আবার জঙ্গলের ছেলেকে জঙ্গলে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।

ফাদার লিন্ডন তাই বােধ হয় সতর্ক হয়েছেন। স্টিফান হােরাে যদি আবার জংলি হয়ে যায়, সে পরাজয় আর অপমান বড়াে বেশি করে বুকে বাজবে। সহ্য করা কঠিন হবে। লিন্ডন জানেন প্রতি মঙ্গলবারের হাটে বুড়াে সােখা আসে। একটা আরণ্য-তাত্মা প্রতিশােধ নেবার জন্য যেন আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, সুযােগ খুঁজছে। চা-বিস্কুট-টেনিস-- সুসভ্যতার এক একটি প্রসাদ খাইয়ে হােরােকে যেন পােষ মানিয়ে রাখতে চাইছিলেন ফাদার লিন্ডন।

আমরা বলতাম- চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ। দেখা যাক, কে জেতে কে হারে। গুড ফ্রাইডের ছুটিতে সবাই দেশে যাবার ছুটি পেল। টুডু টিপ্পা বেস্ত্র খাকো সবাই চলে গেল। ওদের পক্ষে যাবার কোনাে বাধা ছিল না। কাঁধের লাঠিতে এক একটা পোঁটলা ঝুলিয়ে জঙ্গলের পথে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল একটানা হেঁটে ওরা চলে যাবে নিজের নিজের ডিহিতে! কোনাে পাথেয় দরকার হয় না। ততখানি পয়সা খরচ করার সামর্থ্যও নেই ওদের।

কিন্তু হােরােকে ছুটি দিতে রীতিমতাে বিচলিত হয়ে পড়লেন ফাদার লিন্ডন। হােরাে যেদিন গেল, সার্ভিস বাসটা এসে দাঁড়াল বাের্ডিংয়ের কাছে। আমরা দেখলাম, ফাদার লিন্ডন মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করছেন, বাসের টিকিট কিনে দিচ্ছেন হােরােকে।

আমাদের মধ্যে বাজি ধরা হল— হােরাে আর ফিরে আসবে কিনা। ইন্দু বলল নিশ্চয়ই আসবে। ফাদার লিন্ডন ওর জংলিপনা ঘুচিয়ে দিয়েছেন। দুবেলা চা-বিস্কুট মারছে আজকাল। তার আস্বাদ কি ভুলতে পারবে হােরাে!

আমি বললাম আর ফিরে আসবে না হেরাে। এখানে না হয় চা-বিস্কুট আছে, কিন্তু ওদিকে যে...

ইন্দু- ওদিকে কি ?

বললাম- চিরকি মুরমুকে ভুলে গেলে?

ইন্দু একটু নিরাশ হয়ে পড়ল। তাই তাে!

ছুটি ফুরিয়ে গেলে আবার বাের্ডিংয়ের জীবন চঞ্চল হয়ে উঠল। সবাই এসেছে। স্টিফান হােরাে ফিরে এসেছে। ইন্দুর জিত হল। আমরা নিরাশ হয়ে পড়লাম। রাগ হল হােরাের ওপর। হােরােটা সত্যিই একটা গবেট ও বেরসিক।

কিন্তু টুডুর কাছে গল্প শুনে আমাদের এই আক্ষেপ মুহূর্তে মুছে গেল। আমরা শুনলাম বুড়াে সােখার কথা, হােরাের কথা, চিরকি মুরমুর কথা। হােরােদের জঙ্গলের ছবিটা মুহূর্তের মধ্যে যেন দূরের ফোটা পলাশের আলেয়ার মতাে আমাদের কল্পনার সীমার পারে দুলতে শুরু করে দিল। ইন্দু বলল— চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধে বুড়াে সােখার জয় অবধারিত।

হােরাের পাশের ডিহির ছেলে টুডু। খ্রিস্টান টুডুরা অখ্রিস্টানদের সঙ্গে মেশে । টুডু তবু যেন গােয়েন্দার মতাে হেরাের সব কীর্তি দেখে এসেছে। তবে টুডু প্রাণ থাকতে ফাদার লিন্ডনের কানে এসব কথা কখনও তুলবে না। হােরাের ওপর প্রচণ্ড একটা শ্রদ্ধা ও মমতা আছে টুডুর। হােরাের কাছে গিয়ে কিছু বলতে পারে না বলেই আমাদের কাছে বলে। বলে বলে যেন স্তব্ধ শ্রদ্ধার বেদনা খানিকটা হালকা করে নেয়।

টুডু দেখেছে—একদিন তির দিয়ে একটা হরিণ মেরেছিল হােরাে। স্রোতের ধারে হােররা দাঁড়িয়ে ছিল ধনুক হাতে। চিরকি মুরমু তার পা ধুইয়ে দিচ্ছিল। টুডু দেখেছে— চিরকি তাদের গায়ের ঘুমঘর থেকে জ্যোৎস্নারাতে চুপে চুপে পালিয়ে এসেছে। হােরাে আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চিরকিকে হাতে ধরে নিয়ে গেছে।

টুডু দেখেছে— হােরাে খ্রিস্টান হয়েও আখারাতে গিয়ে মাদল বাজিয়েছে। চিরকিও নাচে কিনা সেখানে। বুড়াে সােখা ভালােবাসে হােরােকে। কেউ তাই হােরােকে ঘৃণা করে না।

টুডু বলল— জংলিদের সঙ্গে মিশে দুদিন সেন্ডেরা করেছে হােরাে। টাঙি হাতে উৎসবে পাগলের মতাে নেচেছে। শিমূল গাছে আগুন ধরিয়েছে, দাউ দাউ করে আগুন জ্বলেছে। সবার আগে এক লাফ দিয়ে এক কোপে জ্বলন্ত গাছ কেটেছে হােরাে।

টুডু গলার স্বর খুব অস্পষ্ট করে ভয়ে ভয়ে বলল— আমি দেখেছি, তার পর গায়ের ফোস্কাতে ঠান্ডা বাতাস লাগবার জন্য আড়ালে গিয়ে দাঁড়িয়েছে হােরাে! চিরুকি মুরমু আস্তে আস্তে এসে হােরােকে বুকে জড়িয়ে ধরেছে।

বাের্ডিংয়ের পাশে ছােটো মাঠের ঘাসের ওপর সন্ধ্যার অন্ধকারে বসে আমরা টুডুর গল্প শুনেছিলাম। হঠাৎ বাের্ডিংয়ের বারান্দা থেকে একটা বাঁশির স্বর ভেসে এল। সঙ্গে সঙ্গে তারই সঙ্গে মিলিয়ে, তালে তালে মাথা দুলিয়ে, টুডু গুনগুন করে গাইতে লাগল।

রাতা মাতা বিরকো তালা রে নালাে হােম নির জা রাগা ইংগা

উৎফুল্ল টুডুর হাবভাব আর উৎসাহ দেখে মনে হল, এখনি সে নাচতে শুরু করে দেবে।

—কে বাজাচ্ছে বাঁশি। কে ?

আমাদের ব্যস্ত জিজ্ঞাসার উত্তরে টুডু গান থামিয়ে বলল— ওই, সেই গান। হােরাে সেই সুরটা বাজাচ্ছে।

-কোন্ গান।

—চিরকি মুরমুর গান।

—গানটার মানে কী টুডু?

টুডু উত্তর দিল— গানটার অর্থ, শােনাে আমার জোয়ান বন্ধু, পালিয়ে যেও না, এই ঘন জঙ্গলে আমায় একা ফেলে চলে যেও না।

একটা পুলকের সার আমাদের মনের অগােচরে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছিল। বললাম— এ যে আমাদেরই মতাে গান টুডু !

ইন্দু চাপা সুরে আবৃত্তি করল। শুন শুন হে পরাণ পিয়া.।
কিছুক্ষণ আবিষ্টের মতাে নিঝুম হয়ে বসেছিলাম আমরা। বােধ হয় আমরা মনে মনে চিরকি মুরমু নামে বনের লতার মতাে না দেখা একটি মেয়েকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলাম না, তােমার বন্ধু পালিয়ে যাবে না। আমরা প্রার্থনা করছি, হােরো তােমার কাছে ফিরে যাবে।

ফাদার লিন্ডনের গর্জন শুনতে পেয়ে চমকে উঠলাম। বাের্ডিংয়ের বারান্দায় অন্ধকারে যেন একটা ধস্তাধস্তি চলেছে। টুডু দৌড়ে গিয়ে ঘটনাটা স্বচক্ষে দেখে ফিরে এল। সন্ত্রস্তের মতাে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। ফাদার লিন্ডন হােরাের বাঁশি ভেঙে দিয়েছে।

আমাদের সবার মনে একসঙ্গে ধক করে কতগুলি প্রতিহিংসার শিখা জ্বলে উঠল। রাগের মাথায় বললাম— ঘা কতক জমিয়ে দিতে পারল না হােরাে?

টুডু বিমর্যভাবে বললে, আমারও কেমন ভয় হচ্ছে। হােরাে বড়াে গোঁয়ার। ফাদারকে এর ফল টের পাইয়ে দেবে স্টিফান।

কিন্তু এর পর স্টিফান হােরাের গোয়ার্তুমির কোনাে প্রমাণ পেলাম না। বরং দেখলাম, গোঁ ধরেছেন ফাদার লিন্ডন। ফাদার লিন্ডনের অভিযান আরম্ভ হয়ে গেছে। প্রতি সপ্তাহে একবার সফরে বের হন। কখনও ভােজপুরি লেঠেল সঙ্গে যায়, কখনও বা আট দশটা কনস্টেবল। থানাতে একটা চিঠি দিলেই কনস্টেবল চলে আসে। যেন একটা যােদ্ধার দল নিয়ে দুদিনের জন্য জঙ্গল এলাকায় অদৃশ্য হয়ে যান ফাদার লিণ্ডন। সত্যিই তিনি একজন ধর্মযােদ্ধা। আমরা শুধু মনমরা হয়ে ভাবতাম ফাদার লিণ্ডনের এই রহস্যময় আনাগােনা কবে বন্ধ হবে? কবে শান্ত হবে তার লালচে মুখের উত্তেজনা?

টুডুর কাছে শুনে স্পষ্ট করে বুঝলাম— মােরাঙ্গি পাহাড়ের মুরমুদের ডিহিতেই ফাদার লিন্ডনের অভিযান শুরু হয়েছে। পাহাড়ের গায় এরই মধ্যে একটি মাটির গির্জা তৈরি করে ফেলেছেন ফাদার লিন্ডন। অরণ্যের বুকের ভেতর ঢুকে তিনি যেন লক্ষ বছরের বৃদ্ধ যত বােঙাদের শিলাময় বেদি কাপিয়ে দিয়ে এসেছেন।

খুব বেশি দিন পার হয়নি, শুনলাম, মােরাঙ্গি পাহাড়ে একটা হাঙ্গামা হয়ে গেছে। মাটির গির্জাটা ভেঙে ধুলাে করে দিয়েছে। কে করেছে?

যে করেছে, তাকে আমরা স্বচক্ষে দেখলাম। বুড়াে সােখা। সেসন জজের আদালতে ভিড়ের মধ্যে মাথা খুঁজে আমরাও রায় শুনলাম— বুড়াে সােখার যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।

স্টিফান হােরােকে দেখতাম, বাের্ডিংয়ের বাগানে একটা বুড়াে বটের ঝুরিতে দোলনা বেঁধে সময় অসময় শুধু দোল খায়। দুলে দুলে যেন এক দুঃসহ গায়ের জ্বালা জুড়িয়ে নিচ্ছে স্টিফান হােরাে।

নন-কো অপারেশনের ঝড় বইল সারা দেশে। আমরা স্কুল ছাড়ব। জালিয়ানওয়ালাবাগের অপমান আমাদের অশান্ত করে তুলল।
আমরা বাঙালি আর বিহারি ছেলেরা স্কুল ছাড়লাম রাজার ছেলেরা কেউ ছাড়ল না। খ্রিস্টান ছেলেরাও নয়— টুডু টিঙ্গা বো খালখাে কেউ নয়। আমরা পিকেটিং করে ওদের বাধা দিতে লাগলাম!

আমাদের খুব ভরসা ছিল, হােরাে আমাদের দলে আসবে। ফাদার লিন্ডন যেভাবে ওকে অপমান করেছে, জীবনে সে আর কোনাে পাদরি বা সাদা-চামড়াকে সহ্য করতে পারবে কিনা সন্দেহ।

আমরা স্কুলের ফটকে পিকেটিং করছিলাম। দেখলাম হােরাে আসছে। স্বতন্ত্র ভারত কি জয়! জয়ধ্বনি করে আমরা হােরােকে অভ্যর্থনা জানালাম।

হােরাে এগিয়ে এসে ইন্দুকে একটা ধাক্কা দিল, পরেশের হাতটা ঠেলে সরিয়ে দিল। বন শুয়ােরের মতাে গোঁ গোঁ করে পথ করে নিয়ে ক্লাসে গিয়ে ঢুকল।

সেইদিন হােরােকে আমরা ভালাে করে চিনলাম। পাদরিদের ক্রীতদাস, মনুষ্যত্বহীন, মর্যাদাশূন্য, মূর্খ জংলি হােরাে। স্বতন্ত্র ভারতবর্ষকে চিনল না, একটু শ্রদ্ধা করল না। চিনল শুধু ওর জঙ্গলটাকে। কিন্তু তাের জঙ্গলটা যে ভারতবর্যের মধ্যেই রে বনবৃষ! ভারতবর্যের বাইরে তাে নয় !

আট বছর পরের কথা। আমি লেপাে খানার ভারপ্রাপ্ত দারােগা। সকালবেলায় কজন বিরসাইট মুডা এসেছে হাজিরা দিতে। জেল থেকে আজই ওরা খালাস পেয়েছে। এখানে হাজিরা দিয়ে তার পর নিজের নিজের ডিহিতে চলে যাবে। বিরসাইটরা অত্যন্ত সন্দেহভাজন জীব। প্রতি বছর হাঙ্গামা বাধায়। পুলিশকে ব্যতিব্যস্ত করে। জঙ্গল আইন মানে না, মহাজনদের পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়, চৌকিদারি ট্যাক্স দিতে চায় না। বাজারে বসলে তােলা দেবে না। জমি ক্রোক করতে গেলে আদালতের পেয়াদাকে টাঙি নিয়ে কাটতে আসে। দুবছর আগে একবার স্বরাজ ঘােষণা করেছিল বিরসাইট মুন্ডারা। পাদরিকে মেরেছে, পুলিশকে মেরেছে, অনেকগুলি পুল ভেঙেছে। ওরমাঝির জঙ্গলে একটা খণ্ডযুদ্ধ হয়েছিল ওদের সঙ্গে।

সব চেয়ে শেষে হাজিরা লেখাতে যে লােকটা উঠে এল তার নাম রুননু হােরাে। ডায়েরির ওপর থেকে চোখ তুলে লােকটার মুখের দিকে তাকালাম। তার মাথার চুলে জংলি খোঁপাটাও জটার চূড়ার মতাে হয়ে গেছে। গলায় একটা ভেলাফলের মালা, আদুড় গা, কোমরে ছােটো একটি কাপড় জড়ানাে। হাতে একটা কঁসার বালা। এই প্রাগৈতিহাসিক সজ্জার মধ্যে শুধু একজোড়া সুশাণিত আধুনিক চোখ...।

বিস্ময় চাপতে গিয়ে তার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে বললামস্টিফান হােরাে।

-লােকটা মিষ্টি হেসে বলল- না না। ঘােষ, আমি রুনু হােরাে।

—তুমিও একজন বিরসাইট ?

–আমি বিরসা ভগবানের শিষ্য!

—বিরসা ভগবান? সে কে?

—সে আমাদের গান্ধি ছিল ঘােষ। আমি তাকে চোখে দেখিনি, আমার বাবার মুখে তার কথা শুনেছি। ইংরেজের জেলখানার অন্ধকারে একজন কয়েদির মতাে মরে গেছে আমাদের বিরসা ভগবান। তার চেহারা দেখতে কেমন ছিল জানাে ঘােষ। —কেমন?

যীশু খ্রিস্টের মতাে।

একটু চুপ করে থেকে হােরাে বলল– আমাদের জঙ্গলে বাইরে থেকে অনেক পাপ এসে ঢুকেছে, ঘােষ। তাই বিরসা ভগবান আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন। তার অনুরােধ কি ভুলতে পারি ?

আমি ডাকলাম। স্টিফান হােরাে।

হােরাে প্রতিবাদ করল। বলাে,

রুনু হােরাে।

চুপ করে গেলাম। হােরাে নিজে থেকেই খুশি হয়ে নানা খবর জিজ্ঞাসা করতে আরম্ভ করল। ইন্দু কোথায়? পরেশ কী করছে?

চার দিক একবার সাবধানে তাকিয়ে নিয়ে হােরােকে প্রশ্ন করলাম— এত রােগা হয়ে গেলে কেন হােরাে ?

হােরাে— আমার টি-বি হয়েছে। আচ্ছা, এবার যাই আমি।

একটা কথা জানবার জন্য মনটা ছটফট করছিল। তবু সংকোচ কাটিয়ে উঠতে পারছিলাম না। শেষে সাহস করে বলেই ফেললাম। একটা খবর জানতে বড়াে ইচ্ছে করছে হােরাে।

হােরাে— বলাে।

জিজ্ঞাসা করলাম চিরকি মুরমু কোথায়?

হােরাে শান্তভাবে উত্তর দিলাে। ও, জানাে না বুঝি? ফাদার লিন্ডনের মিশনে চলে গেছে চিরকি। খ্রিস্টান হয়েছে। এখন হাজারিবাগের কনভেন্টে থাকে।

স্টিফানের চোখের দৃষ্টিটা চিকচিক করে উঠল, তীক্ষ তিরের ফলার মতােই, কিন্তু জলে ভেজা। আর কোনাে কথা জিজ্ঞাসা করা হল না, স্টিফানও নিঃশব্দে চলে গেল।

কাউকে মুখ ফুটে বলতে লজ্জা করবে, একটা ভুলের স্মৃতি কিছুক্ষণের জন্য কাটার মতাে মনের মধ্যে বিধছিল, হয়তাে আমরাই নিরপেক্ষ থেকে চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধে স্টিফানকে হারিয়ে দিলাম। স্টিফানও বনবাসে চলে গেল।

Download

Comments

Post a Comment